বাগ (Bug), সফট্ওয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে খুবই পীড়াদায়ক একটি শব্দের নাম। বাগ-এর কারণে সফট্ওয়্যারে অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল রেজাল্ট বা আউটপুট আসে। এই “বাগ” শব্দটি যিনি সর্বপ্রথম পরিচিত করেন তিনি মার্কিন গণিতবিদ এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানী গ্রেস হোপার (Grace Hopper), যার উপাধি “দ্যা কুইন অফ কোড”। এই লেখায় আমরা জানবো তাঁর সম্পর্কে।
গ্রেস ব্রিউস্টার মুরে ৯ ডিসেম্বর ১৯০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ওয়াল্টার ফ্লেচার মুরে ছিলেন ওলন্দাজদের বংশধর এবং ক্যাম্পবেল ভ্যান হর্ন ছিলেন স্কটিশদের বংশধর। তাঁদের তিন সন্তানের মধ্যে গ্রেস ছিলেন বড়। তাঁর দাদা অ্যালেকজান্ডার উইলশন রাসেল মার্কিন নৌবাহিনীর একজন এডমিরাল ছিলেন, যিনি গৃহযুদ্ধ “ব্যাটল অফ মোবাইল বে”-তে যুদ্ধ করেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই হোপার ছিলেন খুব উৎসুক স্বভাবের। কোন যন্ত্র দেখলেই তিনি চিন্তা করতেন এটি কিভাবে কাজ করে। তাঁর একটি এ্যালার্ম ঘড়ি ছিল। একবার তিনি সেটির প্রত্যেকটি যন্ত্রাংশ খুলে দেখার চেষ্টা করেন এটি কিভাবে কাজ করছে। তখন তাঁর বয়স মাত্র সাত। সুন্দরভাবে ঘড়িটির যন্ত্রাংশ খুলতে পারলেও তিনি সেটি পুনরায় জুড়ে দিয়ে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হন। হোপারের মা বুঝে উঠার আগেই তিনি বাসায় রাখা বাকি সাতটি ঘড়ির পোষ্টমর্টেম করে ফেলেন। তাঁর এই অদম্য কৌতূহলই তাঁকে পরিণত করে কম্পিউটার বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান একজন বৈজ্ঞানিক হিসেবে।
প্রাথমিক শিক্ষার জন্য গ্রেস হোপার নিউজার্সির হেরিটেজ স্কুলে ভর্তি হন। বিজ্ঞান এবং গণিতে তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। সেখানকার পড়াশোনার পার্ট চুকিয়ে ১৯২৪ সালে তিনি নিউ ইয়র্কের ভ্যাসার কলেজে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হন। মজার ব্যাপার হচ্ছে ১৬ বছর বয়সে প্রথম যখন ভ্যাসার কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেন, তখন “ল্যাটিন ভাষা” অংশে খুবই কম নাম্বার পাওয়ায় তিনি ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। ফলে পরের বছর আবার পরীক্ষা দিয়ে ভ্যাসার কলেজে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা তিনি অর্জন করেন।

১৯২৮ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করার পর তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৩০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করার পর তিনি সেই বছরই নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, ভিনসেন্ট ফস্টার হোপারকে বিয়ে করেন এবং তখন থেকেই নিজের নামের সাথে “হোপার” পদবি যুক্ত করেন। ১৯৪৫ সালে ভিনসেন্ট ফস্টার হোপারের সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পরেও তিনি তাঁর “হোপার” পদবি ত্যাগ করেননি।
১৯৩১ সালে তিনি শিক্ষক হিসেবে ভ্যাসার কলেজে যোগদান করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি গণিতে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। তাঁর পিএইচডি থিসিসের শিরোনাম ছিলো, “A New Criterion for Reducibility of Algebraic Equations”। গ্রেস হোপার ছিলেন তাঁর সময়ের স্বল্পসংখ্যক মেয়েদের একজন যিনি গণিত বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত তিনি ভ্যাসার কলেজে এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, ১৯৪৩ সালে তিনি ইউএস নেভীতে যোগদান করেন। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি লেফটান্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের “ব্যুরো অফ অর্ডিনেন্স কম্পিউটেশন” প্রজেক্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি ছিলেন তৃতীয় ব্যক্তি যিনি হার্ভার্ড মার্ক ওয়ান (Harvard Mark I ) কম্পিউটারের প্রোগ্রাম লিখেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে গ্রেস হোপার নৌবাহিনীর মৌলিক দায়িত্ব থেকে সরে আসেন। তবে তিনি রিজার্ভ হিসেবে সেখানে কর্মরত ছিলেন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত। সেইসময় তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মার্ক-১ এবং মার্ক-২ কম্পিউটারের উপরে কাজ করা শুরু করেন। এর মধ্যে হঠাৎ মার্ক-২ কম্পিউটারটি বিকল হয়ে যায়। গ্রেস হপার যন্ত্রটি খোলার পর সেখানে একটি মথ (প্রজাপতি) আবিষ্কার করেন, যেটির কারণে যন্ত্রটি বিকল হয়ে গিয়েছিলো। এই মথটির কথা হপার লগবুকে উল্লেখ করেন (মথটি সহ), এবং এই ঘটনা হতেই কম্পিউটারের সমস্যা বা ত্রুটিকে বাগ (Bug = পোকা) বলা হয়ে থাকে।

১৯৪৯ সালে হোপার “একার্ট মুচলি কম্পিউটার কর্পোরেশান”-এ ম্যাথমেটিশিয়ান হিসেবে যোগদান করেন এবং UNIVAC তৈরি দলের সাথে কাজ করা শুরু করেন। সেই সময়েই হোপার “র্যামিংটন র্যান্ড কর্পোরেশন”-এর সাথে যুক্ত হয়ে সর্বপ্রথম কম্পাইলার তৈরির কাজ শুরু করেন। ১৯৫২ সালে এটি তৈরিতে তিনি সফল হন। কিন্তু বিষয়টি অনেকেই বিশ্বাস করতে কিংবা বুঝতে চাইত না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ
“আমার কাছে একটি সচল কম্পাইলার ছিল যেটি কেউ ছুঁয়েও দেখত না। কারণ সবাই বলত যে কম্পিউটার গণিতের হিসাব ছাড়া আর কিচ্ছু পারে না।”

১৯৫৪ সালে হোপার র্যামিংটন র্যান্ড কোম্পানির ডিরেক্টর হন এবং সেই কোম্পানি থেকেই প্রথম কম্পাইলার নির্ভর প্রোগ্রামিং ভাষা ম্যাথ-মেটিক (MATH-MATIC) এবং ফ্লো-মেটিক (FLOW-MATIC) উদ্ভাবিত হয়। পরবর্তিতে তিনি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত প্রোগ্রামিং ভাষা কোবল (COBOL) তৈরির দলকে সক্রিয় নেতৃত্ব দেন। এখানে তিনি ফ্লো-ম্যাটিক ভাষার কিছু ধারণা ব্যবহার করেন। হোপার বিশ্বাস করতেন, যেকোনো প্রোগ্রামিং ভাষা মেশিন ল্যাঙ্গুয়েজ এর মত না হয়ে ইংরেজি ভাষার কাছাকাছি হওয়াটা হবে যুক্তিসঙ্গত।
মার্কিন নৌবাহিনীর রিজার্ভ থেকে ১৯৬৬ সালে গ্রেস হোপার কমান্ডার মর্যাদা নিয়ে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর নেয়ার পর বেশ কিছু বছর তিনি কম্পিউটিং শিল্পে কাজ করেন। ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মত মেয়ে হিসেবে এককভাবে তিনি “ন্যাশন্যাল মেডেল অফ টেকনোলজি” পুরষ্কার অর্জন করেন।
৮৫ বছর বয়সে ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারি তিনি ভার্জিনিয়ার আর্লিংটনে মৃত্যুবরণ করেন। আর্লিংটন ন্যাশনাল সিমেট্রিতে চিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। কম্পিউটার সায়েন্সে মেয়েদের উৎসাহিত করার জন্য “অ্যাসোসিয়েশন অফ কম্পিউটিং মেশিনারি (ACM)” এর পক্ষ থেকে “গ্রেস মুরে হোপার পুরষ্কার” প্রদান করা হয়ে থাকে । ২০১৩ সালে হোপারের ১০৭ তম জন্মদিনে গুগল ডুডলের মাধ্যমে স্মরণ করা মহান এই গণিতবিদকে।
লেখক : তামান্না নিশাত রিনি।