আমরা যারা কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করি, তাদের কাছে খুব পরিচিত একটা শব্দ শর্টেস্ট প্যাথ অ্যালগরিদম (Shortest Path Algorithm)। ডেইক্স্ট্রা অ্যালগরিদম একটি জনপ্রিয় শর্টেস্ট প্যাথ অ্যালগরদিম। এই অ্যালগরিদমের প্রণেতা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা একজন। তিনি এট্সখার ডেইক্স্ট্রা। টেক-জিনিয়াসের আজকের এই লেখায় আমরা জানবো মহান বিজ্ঞানী এটস্খার ডেইক্স্ট্রা সম্পর্কে।

এটস্খার ওয়াইব ডেইক্স্ট্রা ১৯৩০ সালের ১১ মে নেদারল্যান্ডের রোটেরডেম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবারই ছিল বিজ্ঞানমনস্ক পরিবার। তাঁর বাবা ডিউই ওয়াইব ডেইক্স্ট্রা ছিলেন একজন রসায়নবিদ, যিনি ডাচ্ কেমিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং তাঁর মা ব্রেটজা কর্নেলিয়া ক্রুয়াইপার ছিলেন একজন গণিতবিদ। ডেইক্স্ট্রার মা একজন প্রতিভাবান গণিতবিদ হওয়া সত্ত্বেও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন না। ডেইক্স্ট্রা পরবর্তিতে তাঁর মা সম্পর্কে লেখেনঃ
“তাঁর যেকোন গাণিতিক সমস্যা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সুনিপুণভাবে সমাধান করার এক আশ্চর্্য ক্ষমতা ছিল।”
ডেইক্স্ট্রা, রোটেরডেম শহরেই বেড়ে উঠেন এবং প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন। তিনি ১৯৪২ সালে জিমনেসিয়াম ইরাসমিনিয়াম হাই স্কুলে ভর্তি হন। হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ইংরেজি, গণিত, রসায়ন ইত্যাদি বিষয়ের পাশাপাশি তাঁর গ্রীক, ল্যাটিন, জার্মান ইত্যাদি ভাষা শেখার প্রতিও সমান আগ্রহ ছিল। স্কুলজীবনের শেষ বছরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন আইন নিয়ে পড়াশোনা করে আইনজীবী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার। কারণ তাঁর ইচ্ছা ছিল নেদারল্যান্ডকে জাতিসংঘে উপস্থাপন করা এবং সেটি করার জন্য আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেয়া হবে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। ১৯৪৮ সালে তিনি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে উত্তীর্ণ হন। বিজ্ঞানের বিষয়ে এত ভাল করার ফলে ডেইক্স্ট্রার শিক্ষক এবং বাবা-মা মিলে তাঁকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য রাজি করান। বাবা-মা এবং শিক্ষকদের উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে ডেইক্স্ট্রা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান-এ (Theoretical Physics ) ইউনিভার্সিটি অফ লেইডেন-এ ভর্তি হন।

১৯৫১ সাল, তখন পুরোদমে চলছে ডেইক্স্ট্রার তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষা। সেই বছর সেপ্টেম্বরে তাঁর বাবার চোখ হঠাৎ একটি বিজ্ঞাপনে আটকে যায়। বিজ্ঞাপনটি ছিল ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত তিন সপ্তাহের একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং কোর্সের। ডিউই অর্থাৎ ডেইক্স্ট্রার বাবা চিন্তা করলেন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করতে জানা হবে একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদের জন্য একটি বিশেষ দক্ষতা। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ডেইক্স্ট্রাকে সেই প্রোগ্রামিং শর্ট কোর্সের জন্য নিবন্ধিত করেন।
সেই কোর্স করার জন্য প্রথমবারের মত ডেইক্স্ট্রা নেদারল্যান্ড থেকে বাইরে ইংল্যান্ডে যান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ
“সেটা ছিল আমার জন্য একটি ভীতিকর অভিজ্ঞতা; প্রথমবারের মত আমি নেদারল্যান্ড ছেড়ে যাই, পুরোপুরি নতুন একটি বিষয় নিজে নিজে আমি আত্মস্থ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি সেটা অত্যন্ত পছন্দ করেছিলামও।”
শর্ট প্রোগ্রামিং কোর্সটি সম্পন্ন করার পর ডেইক্স্ট্রা ১৯৫২ সালে ম্যাথমেটিক্যাল সেন্টার ইন আমস্টারডাম-এ খন্ডকালিন চাকুরিতে যোগদান করেন এবং সে সময় তিনি বুঝতে পারেন তাঁর আগ্রহ পদার্থবিজ্ঞান থেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর দিকেই বেশি। তিনি দ্রুত তাঁর তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান ডিগ্রী সমাপ্ত করে প্রোগ্রামার হিসেবে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে তখন প্রোগ্রামার কোন স্বীকৃত পেশা ছিল না। ১৯৫৭ সালে স্যার ডেইক্স্ট্রা যখন মারিয়া সি ডিবার্টস্-কে বিয়ে করতে যান তখন তিনি ঝামেলায় পরে যান। ম্যারেজ লাইসেন্সে “প্রোগ্রামার” পেশাকে আমস্টারডাম কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলস্বরূপ “তাত্ত্বিক পদার্থবিদ” নিজের পেশা হিসেবে ম্যারেজ লাইসেন্সে লিখতে তিনি বাধ্য হন।
১৯৫৬ সালে ডেইক্স্ট্রা শর্টেস্ট প্যাথ অ্যালগরিদম প্রকাশ করেন, যেটা ছিল একটা পয়েন্ট থেকে অন্য আরেকটা পয়েন্টে যাবার জন্য সর্বোত্তম পন্থা। এই অ্যালগরিদমটির সাহায্যে খুব কম সংখ্যক কপার তার ব্যবহার করে বিভিন্ন দরকারি সার্কিটে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করেছিলেন। তিনি এই অ্যালগরিদমটির নাম দিয়েছিলেন, “শর্টেস্ট সাব-স্প্যানিং ট্রি এ্যালগরিদম”।
১৯৬০ তে ডেইক্স্ট্রা কি-বোর্ড এবং কম্পিউটারের মধ্যকার যোগাযোগের জন্য পারস্পারিক বর্জননীতির (mutual exclusion) ধারণার প্রবর্তন করেন, যেটি ১৯৬৪ সাল থেকে আধুনিক প্রসেসর এবং মেমোরী বোর্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেইক্স্ট্রার এই পারস্পারিক বর্জননীতি প্রথম IBM ব্যবহার করে তাদের ৩৬০ আর্কিটেকচারে।

অপারেটিং সিস্টেমের জনপ্রিয় সমস্যা “ডাইনিং ফিলোসপার প্রবলেম” প্রথম স্যার ডেইক্স্ট্রা শনাক্ত করেন। তিনি কম্পিউটার সফট্ওয়্যার শিল্পকে আরো সমৃদ্ধ করেন গো টু (GOTO) স্টেটমেন্টকে বিপদজনক ঘোষণা করে (Go To considered harmful) । ১৯৬৮ সালে এই বিষয়ে “এ কেস অ্যাগেইনস্ট গো টু স্টেটমেন্ট (A case against Go To statement)” শিরোনামে তিনি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
এটস্খার ডেইক্স্ট্রা অ্যালগোল 60 (ALGOL 60)-এর একজন বিশেষ ভক্ত ছিলেন এবং এই ল্যাঙ্গুয়েজের কম্পাইলার তৈরিতেও তিনি মৌলিক অবদান রাখেন।
১৯৭২ সালে মহান বিজ্ঞানী এটস্খার ডেইক্স্ট্রা কম্পিউটার বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ পুরষ্কার টুরিং পুরষ্কার লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বারোজ রিসার্চ ফেলো হন এবং ১৯৮৪ সালে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন।

কম্পিউটার সায়েন্স সম্পর্কে তাঁর উক্তি ছিলঃ “মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা যে কম্পিউটার সায়েন্সের কাজ হচ্ছে যন্ত্র এবং এর যন্ত্রাংশ নিয়ে। যেটি আসলে সত্যি নয়”।
মহান এই বিজ্ঞানি দীর্ঘসময় ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে ২০০২ সালের ৬ আগস্ট নেদারল্যান্ডের ন্যুইনেন শহরের মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি “সেলফ স্ট্যাবিলাইজেশন অফ প্রোগ্রাম কম্পিউটেশন” এ কাজের অবদান স্বরূপ এসিএম পিওডিসি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল পেপার অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর সেই বছরই তাঁর সম্মানার্থে ডিস্ট্রিবিউটেড কম্পিউটিং এর উপর দেয়া এসিএম পিওডিসি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল পেপার অ্যাওয়ার্ডকে “ডেইক্স্ট্রা অ্যাওয়ার্ড” নামকরণ করা হয়।
লেখক : তামান্না নিশাত রিনি।