“গুগল” – আজকের এই যুগে সবার কাছে অতি প্রয়োজনীয় এবং পরিচিত একটি নাম। যেটির শুরু হয়েছিল একজনের ব্যক্তিগত গ্যারেজ থেকে। তথ্য খোঁজার ব্যাপারে সে একজন জিনিয়াস। আজকের এই লেখায় আমরা জানবো বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী ল্যারি পেজ সম্পর্কে।
লরেন্স ল্যারি পেজ ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যের ইষ্ট ল্যান্সিং এ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কার্ল ভিনসেন্ট পেজ এবং মা গ্লোরিয়া পেজ দুইজনেই ছিলেন মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের শিক্ষক। যদিও ল্যারির মা গ্লোরিয়া একজন ইহুদি ছিলেন, কিন্তু ছোটবেলা থেকে তিনি ল্যারিকে কোন ধর্মীয় মতবাদের গড়ে উঠার ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করেননি।
কম্পিউটার বিজ্ঞানী বাবা-মায়ের সন্তান হিসেবে ল্যারি পেইজ বড় হচ্ছিলেন বিজ্ঞান, কম্পিউটার ও প্রযুক্তি ঘেরা পরিবেশে । ল্যারি তাঁর ছোটবেলা সম্পর্কে বলেন, “আমাদের বাসায় কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং টেকনোলজিক্যাল বইয়ের ছড়াছড়ি ছিলো। ছোটবেলায় আমি সেসব নিয়ে মগ্ন থাকতাম। ১২ বছর বয়সেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে আমি একটি প্রতিষ্ঠান করতে যাচ্ছি।”
কম্পিউটারের উপর ল্যারির প্রথম আগ্রহ জন্মে যখন তাঁর বয়স মাত্র ৬ বছর। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়া প্রথম শিশু হিসেবে তিনি ওয়ার্ড প্রসেসিং ব্যবহার করে একটি এ্যাসাইনমেন্ট জমা দেন। বড় ভাইয়ের উৎসাহে তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেনঃ “খুব ছোটবেলায় আমি বুঝতে পারি আমার আবিষ্কারের একটা নেশা রয়েছে। সেই থেকে আমি প্রযুক্তি এবং ব্যবসায় আগ্রহী হয়ে উঠি।”
ল্যারি ওকেমস মন্টেসরী রেডমুর স্কুলে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর ইষ্ট ল্যান্সিং হাই স্কুলে ভর্তি হন । সেখান থেকে ১৯৯১ সালে পাশ করার পর তিনি মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হন। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি লেগো দিয়ে একটি ইঞ্জেক্ট প্রিন্টার তৈরি করেন। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর ল্যারি স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। ১৯৯৩ সালে তিনি সৌর গাড়ি নির্মান গবেষণার সদস্য হন।

স্নাতকোত্তর শেষ করার পর তিনি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হন। বসন্তকালীন পিএইচডি অরিয়েন্টেশনের সময় সার্জে ব্রিনের সাথে ল্যারি পেজের দেখা হয়। তখন থেকেই তাঁরা বন্ধু হয়ে যান। দুই বন্ধু মিলে পেজ র্যাংক অ্যালগরিদম উদ্ভাবন করেন। কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডি করার সময় তিনি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের গানিতিক বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করেন। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের বিশাল লিংক ভান্ডার এবং কনটেন্ট নিয়ে তিনি এবং সার্গেই ব্রিন গবেষণা প্রোজেক্ট করেন, যার নাম দেন ব্যাকরাব (BackRub)।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির রিসার্চ প্রজেক্ট হিসেবে দুই বন্ধু ল্যারি এবং সার্গেই একটি সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করেন, যেটির কাজ ছিলো জনপ্রিয় পেজগুলোর তালিকা করে সবচেয়ে জনপ্রিয় পেজের তথ্যকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করা। সার্চ ইঞ্জিনটির কাজ শুরু হয় ল্যারি এবং সার্গেই-এর এক সহপাঠীর গ্যারেজে। এই সার্চ ইঞ্জিনটির নাম তাঁরা দেন “গুগল”। ১৯৯৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর Google.com নামে একটি ডোমেইন তাঁরা নিবন্ধন করেন।

সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করলেও নতুন একটি কোম্পানি খোলার মত টাকা দুই বন্ধুর কাছে ছিলো না । এবার দুই বন্ধু নেমে গেলের অর্থ যোগানের কাজে। সেইসময় দুই বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়ান সান মাইক্রো সিস্টেমের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এন্ডি বেথটোশেইম। কোম্পানি হওয়ার আগেই তিনি পেজ আর ব্রিনকে এক লাখ ডলার দেন। পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং অন্যান্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে যোগার করলেন ১ মিলিয়ন ডলার। এই অর্থ দিয়েই ল্যারি পেজ সার্জে ব্রিন ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন “গুগল ইনকর্পোরেট”। এই সময় তারা ৬০ মিলিয়ন পেজ ইনডেক্স করে ফেলেন। আর গুগলের সার্চ রেজাল্ট ঐ সময়ের সার্চ ইঞ্জিনগুলোর চেয়ে ভাল অবস্থান করে ফেলে। সেই থেকে গুগল হয়ে উঠে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন। শুরুটা গ্যারেজে হলেও দুই বছরের মাথাতেই ল্যারি পেইজ ও সার্জেই ব্রিন তাদের কোম্পানী স্থানান্তর করে নিয়ে যান ১৬৫ ইউনিভার্সিটি এভিনিউ- পালো আল্টো তে। তিন বছরের মাথায় গুগলের প্রতিটি শেয়ারের মূল্য দাঁড়ায় ৭০০ ডলারে!
ল্যারি পেইজ ২০০৭ সালের ৮ ডিসেম্বর লুসিন্ডা সাউথওয়ার্থকে বিয়ে করেন। বর্তমানে ল্যারি পেইজ এক সন্তানের জনক।
২০শে জানুয়ারি, ২০১১ সালে পেইজকে গুগলের প্রধান নির্বাহী ঘোষণা দেওয়া হয় এবং তিনি ৪ঠা এপ্রিল, ২০১১ থেকে দায়িত্ব পালন করেন। গুগল এর নতুন সিইও হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর গুগলের ল্যারি পেইজ বার্ষিক ১.২৫ মিলিয়ন ডলার বেতন পান।
বর্তমানে ল্যারি পেইজ ভোকাল-কর্ড প্যারালাইসিস এ আক্রান্ত। এটি তার কণ্ঠ ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিচ্ছে, তবে প্রাত্যহিক কাজে কোন সমস্যা হচ্ছে না। ১৪ বছর আগে খুব খারাপভাবে ঠাণ্ডায় আক্রান্ত হওয়ার পর তার একটি ভোকাল কর্ড প্যারালাইজড হয়ে যায় এবং ডাক্তার এর কোন কারণ খুঁজে না পাওয়ায় তার গলার স্বর এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তই থেকে গেছে।
ফরচুন সাময়িকীর চোখে ২০১৪ সালের বর্ষসেরা ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব (বিজনেস পারসন অব দ্য ইয়ার) নির্বাচিত হয়েছেন গুগলের প্রধান নির্বাহী ল্যারি পেজ। এছাড়া ২০১১ সালে পেজ ইউ এস সাময়িকী ফোর্বসের তালিকা অনুযায়ী বিশ্বের ১১তম সেরা ধনী ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচিত হন।