থেরাপ সার্ভিসেস লিমিটেড কর্তৃক আয়োজিত নিয়মিত ওয়েবিনারের একটি পর্ব ছিল প্রোগ্রামিং ক্যারিয়ার নিয়ে। সেখানে বক্তা ছিলেন থেরাপের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা (সিটিও) মোজাহেদুল হক আবুল হাসনাত (মাসুম)। থেরাপ কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে সেই ওয়েবিনার থেকে টেক্সটে রূপান্তর করে আমার ব্লগের পাঠকদের জন্য পোস্ট করলাম। আশা করি অনেকেরই এটা কাজে লাগবে।
ক্যারিয়ার এডভাইজ (১ম পর্ব)
আজকের আমাদের প্রোগ্রামের মূল বিষয় হচ্ছে ক্যারিয়ার এডভাইজ। বেসিক্যালি আইটি ইন্ডাস্ট্রি কোন দিকে যাচ্ছে এটার ব্যাপারে কিছুটা ধারণা দেয়া। আমাদের উপস্থিত শ্রোতাদের বেশির ভাগই হচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কিছু কিছু আছেন যারা সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করছেন। যেহেতু প্রায় ৯৫% শ্রোতা হচ্ছে ছাত্র, তাই আমাদের টার্গেট স্রোতারা হচ্ছে ছাত্ররা, কিন্তু যারা চাকরি করছেন তাদের জন্যও উপকারি হবে আজকের ওয়েবিনারটা।
থেরাপ সম্পর্কে কিছু কথা
প্রথমে আমাদের কোম্পানি সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। আমাদের মূল কোম্পানিটা হচ্ছে থেরাপ সার্ভিসেস। এটা একটা আমেরিকান কোম্পানি। আমরা অনেকগুলো প্রোডাক্ট তৈরি করি এবং বিক্রি করি। আমাদের মার্কেটটা হচ্ছে ইউএসএ (USA) আর আমাদের মডেলটা হচ্ছে SaaS। SaaS হচ্ছে Software as a Service। এর মানে হচ্ছে আমাদের কাস্টমাররা আমাদের সফটওয়্যারটা সিডিতে কিনে নেয় না অথবা সফটওয়্যারটা কিনে তাদের মেশিনে ইন্সটল করতে হয় না। সফটওয়্যারটা আমাদের ডাটা সেন্টারে রান করছে এবং ওরা ওয়েব এর মাধ্যমে এসে আমাদের সফটওয়্যারটা ব্যবহারের সুযোগ পায়। আর এই সফটওয়্যারটা ব্যবহারের বিনিময়ে আমাদেরকে বাৎসরিক একটা ফি দেয়।এবং আমরা তাদেরকে যে সার্ভিসটা দিচ্ছি তা শুধু সফটওয়্যার না, সফটওয়্যারটা ব্যবহার করে যে ডাটা ঢুকাচ্ছে সেই ডাটা ঠিকভাবে সেইভ করা মানে এটা সঠিক স্টোরেজে রাখা এবং যেন কখনো মুছে না যায় সেই নিশ্চয়তা দেওয়া, এটা সঠিকভাবে ব্যাকআপ করা এবং এ সম্পর্কিত আরো সেবা আছে। আমরা প্রায় ১১ বছর ধরে আমেরিকাতে এটা করছি। থেরাপ সার্ভিসেস যে পণ্য গুলো বিক্রি করি আমরা, সেগুলো থেরাপ অ্যাপ্লিকেশন এর ভিতরে থাকে। থেরাপ অ্যাপ্লিকেশনের ভিতরে অনেকগুলো, প্রায় ৭০-৮০টা বিভিন্ন সাব অ্যাপ্লিকেশান বা মডিউল আছে যেটা বিভিন্ন ইউজাররা ব্যবহার করছে। ইউএসএ-এর স্বাস্থ্যখাতে আমাদের অ্যাপ্লিকেশানের ডেইলি একটিভ ইউজার হচ্ছে প্রায় দুই লক্ষ। মানে ২ লাখ ব্যবহারকারী প্রতিদিন থেরাপ ব্যবহার করছে। থেরাপ ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করছে এবং এ ডাটা যেসব মানুষের জন্য রাখা হয়েছে সেইসব মানুষের সংখ্যাও প্রায় ২ লাখ। ইউএসএ-এর ৫০টা স্টেটের মধ্যে প্রায় ৪৮টা স্টেটে আমাদের গ্রাহক আছে। আমাদের গ্রাহকরা শুধু প্রাইভেট কোম্পানি না, বিভিন্ন স্টেট গভর্নমেন্টও আমাদের গ্রাহক। কাজেই সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ধরণের গ্রাহকই আমাদের আছে।
এবার বলব থেরাপ বিডি সম্পর্কে। থেরাপ সার্ভিসেস হচ্ছে আমাদের মূল কোম্পানি আর থেরাপ বিডি লিমিটেড হচ্ছে বাংলাদেশে থেরাপ সার্ভিসেসের একটা সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ঢাকার বনানীতে আমাদের অফিস এবং এখানে প্রায় আমরা ১৩০ জন কর্মী আছি। ইউএসএতে আমাদের যে প্রোডাক্টটা বিক্রি হচ্ছে এটার একদম শুরু থেকে মানে রিকয়ারমেন্ট যোগানো, ডিজাইন, এনালাইসিস, কোডিং, টেস্টিং, ডেলিভারি সবকিছু এই বাংলাদেশের অফিস থেকে হয়। ইউএসএতে মুলত আমাদের মার্কেটিং এবং সেলস এই দুইটা অংশ আছে। আমার জানামতে বাংলাদেশে এরকম সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি আর নেই।
মাসুম ভাইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
প্রফেশনালি প্রোগ্রামিং করছি ১৯৯৬ সাল থেকে। ছোটবেলা থেকেই প্রোগ্রামিং কন্টেস্ট করতাম। সম্ভবত ক্লাস এইট বা নাইন থেকেই প্রোগ্রামিং করা শুরু করি এবং সেটা শুরু করেছি বই পড়ে পড়ে। কম্পিউটার ধরার আগে প্রোগ্রামিং করতাম খাতায়, খাতায়ই রেজাল্ট পেতাম। কম্পিউটার ধরার সুযোগ হয় যখন আমি নটরডেম কলেজে ভর্তি হই। নটরডেম কলেজে একটা কম্পিউটার ক্লাব ছিল, সেটা এই ক্ষেত্রে ভাল ভূমিকা পালন করেছে। ঐ ক্লাবের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলাম। ওখান থেকেই কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং করতাম। যেহেতু আগে থেকেই প্রোগ্রামিং জানতাম সেহেতু তেমন একটা অসুবিধা হয়নি এবং ঐ সময় থেকেই বিভিন্ন প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে যোগ দিতাম। শুরুতে লিনাক্সের উপর বেশ ঝোঁক ছিল। তোমাদের যারা সিনিয়র ভাই’রা আছেন, তারা হয়ত বিডিলাগ-এর নাম শুনে থাকবে, সেই “বাংলাদেশ লিনাক্স ইউজারস গ্রুপ” এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম। বুয়েট থেকে গ্রাজুয়েশন করেছি ২০০১ এ। আমাদের ব্যাচ হল ৯৪ অর্থাৎ এইচএইচসি’৯৪ ছিলাম। সেশন জ্যাম ছিল, তাই চার বছরের জায়গায় সাত বছর লেগেছে। বুয়েট থেকে পাশ করে বের হবার আগে থেকেই প্রফেশনাল প্রোগ্রামিং করছি। বুয়েটে পড়া অবস্থায়ই বেশ নাম করা আইএসপি অগ্নি সিস্টেম লিমিটেডে কর্মরত ছিলাম এবং বেশ কিছু সিস্টেম ডেভেলপ করেছি সেই সময়ে। আর থেরাপ বিডিতে আছি ২০০৩ থেকে অর্থাৎ থেরাপ যখন থেকে বাংলাদেশে শুরু হয়, তখন থেকেই আছি। যদিও আমার টাইটেল CTO কিন্তু বেসিক্যালি আমি প্রধান সফটওয়্যার ডেভেলপার-ডিজাইনারও।
বিভিন্ন ধরনের ক্যারিয়ার
এবার আসি আমাদের মূল টপিকেঃ ক্যারিয়ার প্রস্পেক্ট। যারা কম্পিউটার সাইন্স পড়ছ, যারা কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছ এবং কাছাকাছি ক্ষেত্রে পড়ছ, তাদের এই সফটওয়্যার লাইনে কী কী ক্যারিয়ার থাকতে পারে। আমাদের ছাত্রদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে যে কম্পিউটার সাইন্স পড়লে শুধু প্রোগ্রামারই হওয়া যায় আর মাথার মধ্যে কিভাবে যেন ঢুকে যায় প্রোগ্রামিং ছাড়া আর কোন ক্যারিয়ার নাই। এই ভুল ধারণাটা আমি ভাঙ্গাতে চাই। আসলে আমি যেই টপিকগুলো কাভার করব বেশির ভাগ হচ্ছে অনেক ভুল ধারণা ভাঙ্গাবার জন্য। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট একটি খুব ভাল ক্যারিয়ার কিন্তু ওটার পাশাপাশি আরও অনেক ক্যারিয়ার আছে যেগুলো সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মত কোম্পানিতে যদি শুধু সফটওয়্যার ডেভেলপার থাকতো তাহলে চলতোনা। কারণ একটা সফটওয়্যার তৈরি করে ওইটা গ্রাহকের কাছে ডেলিভারি করা পর্যন্ত এবং গ্রাহক যেন সেটা ব্যবহার করতে পারে সেটা নিশ্চিত করা পর্যন্ত অনেক লোকের প্রয়োজন। বিভিন্ন রোলের লোকের প্রয়োজন। এদের বেশির ভাগই আইটি ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকজন। কিন্তু নন-আইটি ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকজনেরও প্রয়োজন। আচ্ছা, আজকের বক্তৃতায় আমরা আইটিতে মনোযোগ দিচ্ছি, নন-আইটি কাভার করছি না।
একটা সফটওয়্যার তৈরি করে গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এগুলো লাগে :
- সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট
- সফটওয়্যার টেস্টিং
- ডাটাবেজ
- সিস্টেম অ্যাডমিনিসট্রেশন
- নেটওয়ার্ক অ্যাডমিনিসট্রেশন
- এনালিস্ট
- প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট
যারা কম্পিউটার সাইন্স পড়ছ বা কাছাকাছি ফিল্ডে আছ তারা শুধু সফটওয়্যার ডেভেলপার স্বপ্ন দেখলেই চলবে না। অনেককে অন্যান্য স্বপ্নও দেখতে হবে। অনেককে সফটওয়্যার টেস্টার হবার, ডাটাবেজ অ্যাডমিনিসট্রেটর, ডাটাবেজ প্রোগ্রামার হবার স্বপ্ন দেখতে হবে। তা না হলে, আমরা তো সফটওয়্যার ডেলিভারি করতে পারব না। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট একটা পরিচিত ব্যাপার, এটা সম্পর্কে তোমরা সবাই জানো, তাই এটা সম্পর্কে বেশি কিছু বলব না। একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট বা প্রোগ্রামার এই পোস্টটা আর অন্য যত গুলো পোস্ট দেখালাম, সবগুলোর স্টার্টিং পয়েন্ট হতে পারে। এর মানে তুমি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলে, তারপর সফটওয়্যার টেস্টিংএ যেতে পার, ডাটাবেজে যেতে পার, সিস্টেম অ্যাডমিনিট্রেসনে যেতে পার, নেটওয়ার্ক অ্যাডমিনিট্রেসনে যেতে পার, এনালিস্ট, প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি বিভিন্ন ট্র্যাকে যেতে পার। একজন ভালো প্রোগ্রামার নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী, কোম্পানির প্রয়োজন অনুযায়ী, ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজন অনুযায়ী খুব সহজেই বিভিন্ন দিকে যেতে পারে। এবং এটা আমাদের কোম্পানিতেও হয়। একটা জিনিস আমরা অনেক সময় মিস করি যে, প্রোগ্রামার হতে হলে হয়তো শুধুমাত্র কম্পিউটার সাইন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বা কম্পিউটার সাইন্স বিষয়ে গ্রাজুয়েশন থাকতে হবে। এটা ঠিক না। আমার নিজের বেলাই এটা ঠিক না। আমি ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্রাজুয়েট। আর তোমরা দেখলে যে আমি গ্রাজুয়েশন পাশ করার অনেক আগে থেকেই প্রফেশনাল প্রোগ্রামিং করছি। এরকম অনেক আমার জানা আছে, অনেক ভালো প্রোগ্রামার আছে যারা কম্পিউটার সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসেনি, কাছাকাছি ফিল্ড থেকে এসেছে। এমনকি অনেক দূরের ফিল্ড থেকেও এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ থেকে এসেছে, সমাজবিজ্ঞান থেকে এসেছে, যারা এখন ভালো প্রোগ্রামার হয়েছে। প্রোগ্রামিং এর একটা মজার জিনিস হচ্ছে যে, এটা নিজেকে শেখানো যায়। বই পড়ে এবং অনলাইনে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্লগ-আর্টিকেল থেকে প্রোগ্রামিং শেখা যায়। এটা একটা মজার জিনিস যে, এখন ইন্টারনেটের প্রসার হয়েছে এবং সহজলভ্য হয়েছে বাংলাদেশের সব জায়গাতে। আগে বইয়ের প্রয়োজন ছিল বেশি, ইন্টারনেট অত সহজলভ্য ছিল না। আর এখন অনেক সহজলভ্য এবং সবই পাওয়া যায়। বই কিনতে হবে না প্রোগ্রামিং শিখতে গেলে। এখানে একটা উপদেশ হল যে, লেটেস্ট ক্রেজ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। মাথায় রাখতে হবে আমি প্রোগ্রামার হব। যারা কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়ছ তারা ইতিমধ্যে বেশ কিছু পড়ে ফেলেছো। আর যারা পড়ছ না, তারা বেসিক যে কোনো একটা ল্যাঙ্গুয়েজ পছন্দ করে প্রোগ্রামিং শুরু করতে হবে। প্রথমে একজন ভালো প্রোগ্রামার হতে হবে, তারপর কোন নির্দিষ্ট টেকনোলজি রপ্ত করতে বেশি সময় লাগবে না। আর এই ওয়েবিনারের শেষের দিকে গিয়ে আর কিছু কাভার করব।
লেখাটি মোট চার পর্বের। পরবর্তী পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।